শহীদ তাজুল ইসলাম

মুখোমুখি লড়াইয়ে মৃত্যু গৌরবের, কিন্তু যে জীবন মৃত্যুর তরে উৎসর্গীকৃত, যে জীবন আরো অসংখ্য জীবনকে বাঁচার স্বপ্ন শেখায় সে জীবনকে কী দিয়ে মাপা যাবে। তাজুল একটি অনুপ্রেরণার নাম, সারা বাঙলা খুঁজে আর একটি পাওয়া যাবেনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে শোষণ বঞ্চণাহীন সমাজ নির্মাণে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য চাকরি নিয়েছিলেন আদমজীতে, বদলি শ্রমিক হিসেবে । পারিবারিক সকল সুবিধাদি তুচ্ছ করে, স্ত্রী-সন্তানসহ পুরো এক দশক কাটিয়েছিলেন শ্রমিকদের সাথে শ্রমিকপল্লীতে । সুবিধাবাদী জীবনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বেছে নিয়েছিলেন সম্মানের জীবন, ইচ্ছে করলেই বাস্তবতার অজুহাতে পাশ কাটাতে পারতেন, কিন্তু ছাত্র ইউনিয়নের কাছ থেকে যে দীক্ষা অর্জন করেছিলেন তার প্রতি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ছিলেন অবিচল ।

কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেছিলেন, ছিলেন আদমজী ট্রেড ইউনিয়নের সহ-সভাপতি, পাটকল ট্রেড ইউনিয়নের আন্তর্জাতিক সম্পাদক । বাংলা ১৩৫০ সালে চাঁদপুরের মতলবে জন্মগ্রহণ করেন। ৭ম শ্রেণীর ছাত্র থাকতেই যোগ দেন ছাত্র ইউনিয়নের পতাকাতলে । ১৯৬৮ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ১ম বিভাগে এইচ এস সি পাশ করে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। ছাত্র সংগঠনের কাজে সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করেছিলেন, অভিভাবকেরা তাকে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ফেরাতে বিয়ে করিয়ে দেন।

বিয়ের রাতেই চাঁদপুর ছেড়ে এসেছিলেন কেন্দ্রীয় সম্মেলনের কাজে অংশগ্রহণের জন্য। ১৯৭৩-৭৪ সালে নির্বাচিত হন। কেন্দ্রীয় সংসদের প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষে মেহনতি শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির লক্ষ্যে ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র ও কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। নিছক বিপ্লব রোমন্থনের জন্য নয়, তিল তিল করে সংগঠন ও আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে আদমজীর শ্রমিক পল্লীতে কাটিয়েছেন ১০ বছর । তাজুল ইসলাম এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে স্বৈরাচারী এরশাদের বিপক্ষে শ্রমিকরা হয়ে ওঠে আন্দোলনের প্রধান চালিকাশক্তি ।

শ্রমিক আন্দোলনের সে স্বর্ণোজ্জ্বল সময়ে আদমজীসহ সমগ্র ঢাকা অঞ্চলের শ্রমিক বেল্টে তাজুল আবির্ভূত হন স্বৈরাচারী এরশাদশাহীর অন্যতম বিপদ হিসেবে। ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ, শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) দাবি আদায়ে হরতাল আহবান করে। হরতাল সফল করতে সমস্ত প্রস্তুতি শেষে বাড়ি ফিরছিলেন বিপ্লবের এ মহানায়ক । পথিমধ্যে স্বৈরাচারের পেটোয়া গু-াবাহিনী তাজুলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাতের কালো আঁধার বিপ্লবের এ লালফুলকে চিরতরে কেঁড়ে নেয় । এ মহান বিপ্লবী তার উত্তরসূরীদের জন্য রেখে গেছেন ইতিহাস হবার আহ্বান ।

তাজুলের আত্মত্যাগ, বিপ্লবের প্রতি অবিচলতা ছাত্র ইউনিয়নের আদর্শকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে। প্রমাণ করেছে বিপ্লবী ধারার ছাত্র আন্দোলনই এদেশে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের মুক্তির সহায়ক । নীল পতাকার হে মহান সৈনিক, বিপ্লবের লাল ফুল-তাজুল ইসলাম; তোমাকে সংগ্রামী অভিবাদন । তোমার আদর্শ, অনুপ্রেরণা হয়ে ছড়িয়ে পড়ুক বাংলার প্রতিটি ঘরে । তোমার রক্তপতাকা হাতে আমরা চলি অবিরাম ।