স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়ন
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদ নিয়ে আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জিয়াউর রহমান ও এরশাদ কয়েক দফা সামরিক শাসন জারি করেন। সকল সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন দুর্বার লড়াই করেছে, ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। সামরিক স্বৈরাচারের নগ্ন হামলায় শহীদ হয়েছেন আমাদের অনেক বিপ্লবী বন্ধু। ১৯৮৬ সালের ৩০ মার্চ স্বৈরাচার এরশাদের লেলিয়ে দেয়া গুণ্ডারা আমাদের সংগঠনের নেতা আসলামকে হত্যা করে। তবুও থেমে থাকেনি ছাত্র ইউনিয়ন তথা ছাত্রসমাজের আন্দোলন।
১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই সূচিত হয় আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে দুর্বার নিষিদ্ধ করে। নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই সূচিত হয় আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে দুর্বার গণআন্দোলন। ’৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আইয়ুবের পতনের পর ইয়াহিয়া খান আবার সামরিক শাসন জারি করলে ছাত্র ইউনিয়ন ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়। ’৭৫-এর বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করে ছাত্র ইউনিয়ন। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য জেল-জুলুম উপেক্ষা করে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে।
১৯৮২ সালে ২৪ মার্চ সামরিক শাসনজারি করে এরশাদ ক্ষমতা দখল করার পর আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ছাত্র ইউনিয়ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। ঘোষিত হয় ছাত্র সমাজের ঐতিহাসিক ১০ দফা কর্মসূচি। শুরু হয় সরকার পতনের আন্দোলন। ছাত্র ইউনিয়ন এ সময় ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের জন্য উদ্যোগী হয়। ছাত্র-জনতার অব্যাহত আন্দোলনে পতন ঘটে স্বৈরাচার এরশাদের। দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এখন পর্যন্ত ছাত্রসমাজের ১০ দফা দাবি উপেক্ষিত। ১০ দফা দাবিগুলো ছিল-
এক.
ক. অবিলম্বে একটি সার্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
খ. বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা, শিক্ষা সংক্রান্ত কর্মসূচি প্রণয়ন এবং সাধারণ জনগণের প্রয়োজনে সকল প্রকার নীতিমালা পরিবর্তন ও সংশোধনের অধিকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দিতে হবে। সকল বৈষম্য দূর করে সারা দেশে অভিন্ন পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে একই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষাকে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে ব্যবহার করা চলবে না।
গ. শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী, সমাজ সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যকে সামনে রেখে পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করতে হবে। দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে প্রদান এবং সঙ্গতিহীন ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রত্যেক মাসে নিয়মিতভাবে শিক্ষাভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
ঘ. জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের পরিমাণ কমপক্ষে জাতীয় আয়ের শতকরা ৮ ভাগ বা জাতীয় বাজেটের ২৫% করতে হবে (ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী)। শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা। পরীক্ষা পদ্ধতিকে আধুনিকীকরণ ও বিজ্ঞানসম্মত করতে হবে। পরীক্ষায় নকল ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। নারী শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
দুই.
ক. শিক্ষাক্ষেত্রে অনুদান বৃদ্ধি করে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-বেতন সমান করতে হবে। শিক্ষা ব্যয়ের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে ছাত্র বৃত্তির পরিমাণ ও সংখ্যা বাড়াতে হবে।
খ. কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে দোকান প্রতিষ্ঠা করে সাবসিডি দিয়ে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের বই-পুস্তক, খাতা-কলম, পেন্সিল, কালি কাগজপত্রসহ সকল শিক্ষা উপকরণ উৎপাদিত মূল্যে সরবরাহ করতে হবে।
গ. নতুন নতুন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করতে হবে এবং এ লক্ষ্যে ক্লাস রুম, ল্যাবরেটারি, হল-হোস্টেল নির্মাণপূর্বক প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্ধিত করতে হবে।
ঘ. শিক্ষা প্রতিষ্ঠনে সকল ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, বিনামূল্যে চিকিৎসা, ব্যায়ামাগার ও খেলার মাঠের ব্যবস্থা, ক্রীড়াবিদদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠাসহ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও খেলাধুলার সুযোগ বাড়াতে হবে। স্কুল পার্যায়ে বাধ্যতামূলক চিত্রকলা ও সঙ্গীত শিক্ষা চালু করতে হবে।
ঙ. শিক্ষকদের উপযুক্ত ও সম্মানজনক পারিশ্রমিক, চাকরির নিশ্চয়তাসহ সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
চ. শিক্ষা জীবন শেষে সকল ছাত্র-ছাত্রীর চাকরির নিশ্চয়তা দিতে হবে। চাকরি না দেয়া পর্যন্ত প্রত্যেককে বেকার ভাতা দিতে হবে।
ছ. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সকল অস্ত্রধারী ও সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীকে উচ্ছেদকল্পে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শান্তি ও নিরাপত্তাপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তিন অবৈধ ক্ষমতা দখল ও দুর্নীতির অভিযোগে অবিলম্বে খুনি এরশাদ এবং তাঁর সহযোগীদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে হবে।
চার.
ক. অবিলম্বে বাক, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বতন্ত্রীকরণ ও স্বাধীনতাসহ সকল মৌলিক অধিকার নিশ্চিত ও সার্বভৌম জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবিধানের সকল অগণতান্ত্রিক অনুচ্ছেদ, ধারা, সংশোধনী বাতিল করে গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন ও পূর্ণ গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
খ.বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল করতে হবে।
গ. সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে গণতান্ত্রিক নীতিমালার ভিত্তিতে টেলিভিশন-বেতারসহ সকল প্রচার মাধ্যমকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে।
পাঁচ.
ক. খাদ্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য কমানো, দুর্ভিক্ষাবস্থা মোকাবেলা ও অর্থনৈতিক মন্দা দূর করতে হবে। বর্ধিত বাস, রেল, লঞ্চ ভাড়া বাতিল করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতকে বেসরকারিকরণ করা চলবে না। সকল প্রকার অপ্রয়োজনীয় বিলাসদ্রব্য আমদানি বন্ধ করতে হবে।
খ. শিক্ষা, কৃষি, চিকিৎসা, যানবাহন ও বাসস্থানের মতো প্রয়োজনীয় খাতে সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। গৃহহীন জনগণের বাসস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
ছয়.
ক. স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা গণচেতনা ও আকাঙ্ক্ষাকে সমুন্নত রাখতে হবে। স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক সাফল্যগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে।
খ. একাত্তরের ঘাতক দালাল, প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী ধর্ম ব্যবসায়ী সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহের মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক ভিত্তির সকল উৎস নির্মূল করতে হবে। পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশের সমস্ত পাওনা আদায় করতে হবে।
গ. মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিসমূহ লংঘন করে ধর্মকে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা চলবে না। সকল নাগরিক তাদের ব্যক্তি জীবনে স্ব-স্ব ধর্মীয় মূল্যবোধ, আচার অনুষ্ঠান স্বাধীনভাবে সংরক্ষণ ও চর্চা করবেন।
সাত.
ক. অর্থেনীতিতে লগ্নি পুঁজির লুন্ঠন নিষিদ্ধ করতে হবে। বহুজাতিক কর্পোরেশনের অবাধ লুণ্ঠন বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে কতিপয় ব্যক্তি কর্তৃক কোটি কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণের টাকা উদ্ধার করতে হবে। দেশের তেল-গ্যাস সম্পদ বিদেশী কোম্পানীর কাছে দেয়া লিজ বাতিল করতে হবে। এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থবিরোধী কোনো পদক্ষেপ নেয়া চলবে না। বিদেশের সঙ্গে সম্পাদিত সকল অসম অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক চুক্তি বাতিল করতে হবে।
খ. আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কনভেনশন অনুযায়ী শ্রমিকদের সকল অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
গ. ১৭টি কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগঠনের ১০ দফা মানতে হবে। কৃষিঋণ আদায়ের নামে সার্টিফিকেট মামলা, ক্লোক হয়রানি বন্ধ করতে হবে।
ঘ. নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে।
আট.
ক. কুরুচিপূর্ণ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও বিদেশী অপসংস্কৃতির প্রসার প্রচারণা বন্ধ করতে হবে। গণমুখী ও সৃজনশীল শিল্প-সংস্কৃতির চর্চার কেন্দ্র হিসেবে গণমাধ্যমগুলোকে গড়ে তুলতে হবে।
খ. সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে মুখ, স্বজনপ্রীতি, চোরাকারবারি, মুনাফাখোরি, কালোবাজারি, বিলাসিতা, অপব্যয়সহ নৈতিকতার পরিপন্থী সকল কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে হবে।
নয়.
অর্পিত (শত্রু) সম্পত্তি আইন বাতিল করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘু জাতিসত্তা সমূহের স্বকীয়তার স্বীকৃতি প্রদান, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিশ্চিত করা এবং তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ সাধনে ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সকল প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
দশ.
সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীল বৈদেশিক নীতির বর্তমান ধারা বাতিল করে স্বাধীন ও সক্রিয় জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করতে হবে। ফিলিস্তিনসহ সকল মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে সুদৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
আওয়ামী লীগ-বিএনপি কোন সরকারই তাদের ওয়াদা রাখেনি। তারা ছাত্রসমাজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ৯০ এর ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী সর্ববৃহৎ ছাত্র আন্দোলনের রূপ দেখা যায় ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে সেনা সদস্য কর্তৃক ছাত্র নির্যাতনের ঘটনায়। ২১ আগস্ট সকাল থেকে সমগ্র দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনের লেলিহান শিখা। জরুরি আইন উপেক্ষা করে চলে লাগাতার মিছিল-বিক্ষোভ-ধর্মঘট। পুলিশ সমগ্র দেশের বিভিন্ন থানায় ছাত্র-শিক্ষকসহ ৮৩ হাজার জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সভাপতি আন্দোলনের নেতা মানবেন্দ্র দেব, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি মন্টি বৈষ্ণব, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি আবু সায়েম। দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতা দখলের হাতিয়ারে পরিণত হওয়া ছাত্র রাজনীতির নেতিবাচক ধারণার পরিবর্তন ঘটায় এই আন্দোলন।