স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্র ইউনিয়ন
বাংলাদেশে প্রথম যে ছাত্র সংগঠনটি পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে এবং বাঙ্গালির স্বাধিকারের দাবিতে আওয়াজ তোলে তা হলো ছাত্র ইউনিয়ন। প্রতিষ্ঠার পর প্রায় এক দশক কাল ধরে তাকে অনেকটা এককভাবেই ইস্যুতে সংগ্রাম করতে হয়েছে। ষাটের দশকে ছাত্রলীগ এ ইস্যুতে তার দোদুল্যমনতা অনেকটা পরিত্যাগ করে এবং বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের আদর্শ নিয়ে অগ্রসর হয়। ছাত্র ইউনিয়ন বাঙ্গালি জাতির স্বাধিকারের ইস্যুকে সত্যিকারভাবেই অর্থবহ করার জন্য তাকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ধারায় অগ্রসর করতে ভূমিকা রাখে।
’৬৬ পরবর্তী সময়ে ছাত্র ইউনিয়ন সারা বাংলার মানুষকে মুক্তি সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। ’৬৯’র গণঅভ্যুত্থানে বাংলার মানুষের জাগরণের অন্যতম রূপকার ছিল ছাত্র ইউনিয়ন। আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিশ্চিত করে তোলে আইয়ুব-মোনায়েম শাসনের চুড়ান্ত পরাজয়। তারপর থেকেই ছাত্র ইউনিয়ন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য রাজনৈতিক প্রস্তুতির কাজ ক্রমান্বয়ে এগিয়ে নেয়। ’৭১ এর ফেব্রুয়ারিতে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকারসহ বাঙ্গালি জাতির পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি ছাত্র ইউনিয়নের ঘোষণাপত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মার্চে ছাত্র ইউনিয়ন শুরু করে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রত্যক্ষ প্রস্তুতি। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা ডামি রাইফেল কাঁধে ঢাকার রাস্তায় মহড়া দেয়। মহড়া শুরু হয় হাতে তৈরি গ্রেনেড দিয়ে।
২৫ মার্চ পূর্ববর্তী সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা গ্রামে গ্রামে অস্থায়ী ট্রেনিং ক্যাম্প প্রস্তুত করে। এছাড়া হানাদার বাহিনীর আক্রমণের সাথে সাথে দেশের সর্বত্র রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড এবং প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলে নীল পতাকার অভিযাত্রীরা। ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন তার সর্বোচ্চ সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে অংশগ্রহণ করে। সর্বত্র অসীম সাহস আর ত্যাগের পরিচয় বহন করে তারা। যুদ্ধে অসংখ্য নেতাকর্মী শহীদ হয়। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির সাথে মিলে গড়ে তোলে দেশের সর্ববৃহৎ গেরিলা বাহিনী। ২০ হাজার সদস্যের এ গেরিলা বাহিনী হাটে-মাঠে-ঘাটে অপদস্থ করে তোলে হানাদার পাকিস্তান বাহিনী আর তার দোসর রাজাকার, শান্তিবাহিনী, আলবদর আর আলশামসদের।
এছাড়াও সারা দেশের ১১টি সেক্টরের সাথে যুক্ত হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অসংখ্য নেতাকর্মী। ঢাকার দুর্ধর্ষ ‘ক্র্যাক প্লাটুন’, বিভিন্ন সেক্টরের এফ. এফ বাহিনী, মেরিন গেরিলা বাহিনী প্রভৃতি ক্ষেত্রে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা সবচেয়ে সাহসী ও দক্ষ যোদ্ধার মর্যাদা অর্জন করে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় গেরিলাযুদ্ধে এবং সম্মুখ যুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন হয়ে ওঠে দুর্বার। এমনি এক সময়ে ১১ই নভেম্বর কুমিল্লার বেতিয়ারায় পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে হারিয়ে যান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা নিজামউদ্দিন আজাদ, সিরাজুম মুনির সহ ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা বাহিনীর ৮ সদস্য।
ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীসহ সারা বাংলার অসংখ্য প্রাণ আর সাড়ে সাত কোটি দেশবাসীর ত্যাগের বিনিময়ে, বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে যে বাংলাদেশের জন্ম হয় তা তার স্বপ্নসাধ বাস্তবায়নের পথে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। যে দুরন্ত স্বপ্ন আর সম্ভাবনা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিলো অল্প কিছুদিন পরেই তা মুখ থুবড়ে পড়ে তৎকালীন শাসকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পরিচালিত স্বাধীনতা বিরোধীদের চক্রান্তে। তাই মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে ফিরিয়ে এনে, স্বাধীনতার লাল সূর্যকে পরিপূর্ণতা দানের লক্ষ্যে ছাত্র ইউনিয়ন এখনো পথ চলছে অবিরাম।