শহীদ রেজাউল করিম নতুন
কুড়িগ্রাম জেলার সদর থানার মোগলবাসা ইউনিয়নের বৈরাগীর বাজার নামক এলাকায় ১৯৭০ সালে নতুনের জন্ম। তাঁর পিতা ফেরদৌস আলী, মা শামছুন নাহার বেগম। শহীদ নতুন নীলারাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে মেধার ভিত্তিতে কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে (জেলা স্কুল) ভর্তি হন। কুড়িগ্রাম সরকারি মহাবিদ্যালয় ও শহীদ নতুনের স্কুল ছিল পাশাপাশি ।
কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর থেকে নতুন প্রতিদিন দেখেছে কলেজের ছাত্ররা সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মিছিল করে। মিছিল হলে স্কুলের ছেলেদের সাথে নতুনও মিছিলে অংশ নিত। নতুন বুঝতে পারতো জেনারেল এরশাদ একজন নরপশু, সে ছাত্রদের হত্যা করেছে, ছাত্ররা সে কারণেই এরশাদের বিরুদ্ধে মিছিল করে । দখলদারিত্ব, সন্ত্রাস, পেশি শক্তির মহড়া রেজাউল করিম নতুন মেনে নিতে পারেনি ।
১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের সান্নিধ্যে নতুন ছাত্র ইউনিয়নে যুক্ত হয়। তাঁর আগ্রহ ও নিষ্ঠার কারণেই কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় স্কুল কমিটিতে তাঁকে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত করা হয়। এছাড়া সে কৃষ্ণপুর বকসী পাড়া আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক হয়। সে সময়টা ছিল স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামের সময়। স্কুলের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও নতুন প্রায় প্রতিদিন মিছিলে অংশ নিত। তাই সে ছাত্রনেতা হিসেবে সে সময় পরিচিতি পায় । সে সময় কুড়িগ্রামে স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে মূখ্য ভূমিকা পালনকারী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের অবদান ছিল অন্যতম। এ কারণে ছাত্র ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ছিল স্থানীয় জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী কুড়িগ্রাম শান্তি কমিটির সভাপতি পাকহানাদারদের দোসর অ্যাড. আলহাজ্ব পনির উদ্দিন আহমেদের পুত্র বিশিষ্ট দালাল এরশাদের মন্ত্রী তাজুল ইসলাম চৌধুরী।
কুড়িগ্রামে তাজুল চৌধুরীর ছত্রছায়ায় স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি সংগঠিত হতে থাকে। আর তাজুল চৌধুরীর বিশেষ ক্ষোভ ছিল ছাত্র ইউনিয়নের প্রতি । পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালের ১৯ মার্চ কুড়িগ্রাম জেলা সদরে সমগ্র জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ‘শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন’-এর ব্যানারে জামায়াত-শিবির প্রকাশ্য মিছিল করে । সেদিন রেজাউল করিম নতুন তাদের মিছিলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মিছিলে থাকা নতুনের বাড়ির এলাকার জামায়াত শিবিরের কয়েকজন নতুনকে দেখে বলে ‘ঐ যে কাদের ধর ধর’ বলে ধাওয়া করলে নতুন কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের শিক্ষকদের আবাসিক কোয়ার্টারে ঢুকে পড়ে ।
জামায়াত শিবির ক্যাডাররা শিক্ষকদের বাসভবনে ঢুকে নতুনকে টেনে হেঁচড়ে বের করে এনে কলেজের ছেলেদের কমনরুমের কাছে লাঠি ও বিভিন্ন অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করে। রেজাউল করিম নতুনের মৃত্যুর খবর শহরে ছড়িয়ে পড়লে হাজারো ছাত্র-জনতা সেদিন জামায়াত শিবিরের বিরুদ্ধে মাঠে নামলে জামায়াত শিবিরের ক্যাডাররা শহর থেকে পালিয়ে যায় । প্রশাসন সেদিন শহরে কারফিউ দিয়ে জনতার প্রতিবাদ বন্ধ করার চেষ্টা করলেও ছাত্র-জনতা কারফিউ উপেক্ষা করে রাজপথে লাশ নিয়ে মিছিল করে। পরের দিন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে লাশ রাখা হলে শহরের বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্ররা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। সেদিন প্রায় পঞ্চাশ হাজারের মতো মানুষ সমবেত হয়েছিল।