শহীদ মির্জা কাদেরুল ইসলাম

১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি । ইউসিস ভবনে যাচ্ছে ছাত্র-জনতা । যাচ্ছে বিচার চাইতে, কেন নাপামের মরণঘাতে নিশ্চিহ্ন মাইলাই গ্রাম, কেন দিনের পর দিন ভিয়েতনামের বীর জনতার উপর অভব্য আক্রমণ । সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের অবিনাশী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এবং ডাকসুর যৌথ মিছিল গগনবিদারী স্লোগানে প্রকম্পিত করছে ঢাকার রাজপথ । সে চিৎকারে ভীত, কম্পমান মার্কিন সাম্রাজ্য; টলে উঠছে দেশে দেশে পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের অন্যায়, অবিচার, হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ । আর মার্কিনের দালালরা স্লোগানের চাবুকে হচ্ছে দিশেহারা ।

স্লোগানের নেতৃত্ব কাদেরের । যে কাদের শোষণহীন সমাজ নির্মাণের ব্রত নিয়ে ভর্তি হয়েছে ঢাকা কলেজে । কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন মনোনীত ধর্ম ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক। সাম্রাজ্যবাদের অহংকারকে মিথ্যায় পরিণত করতে, ভিয়েতনামের বিপ্লবী সরকারকে বাংলার ছাত্র-জনতার অভিবাদন পৌঁছে দিতে কাদেরের কন্ঠ উচ্চকিত । আচমকা সাম্রাজ্যবাদের অনুগতদের হুঁঙ্কার, বিনা উস্কানিতে পুলিশের গুলি। কাদেরের কন্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেল। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ছাত্রহত্যায় শহীদ হলেন ১৬ বছরের এক দুরন্ত স্বপ্ন, মির্জা কাদেরুল ইসলাম। সাথী হলেন শোষণমুক্তির সমাজের স্বপ্নদ্রষ্টা আরেক যোদ্ধা মতিউল ইসলাম ।

মির্জা কাদের ১৯৫৭ সালে (১৭ পৌষ, ১৩৬২ বাংলা) জন্মগ্রহণ করেন। সাংগঠনিকভাবে অসম্ভব দক্ষ এ মেধাবী বালকটির শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণের স্বপ্নের সাথে পরিচয় ঘটে ‘রঙধনু’ খেলাঘরের মাধ্যমে। মাত্র ২-১ বছরের মধ্যে কুলাউড়ায় ‘রঙধনু’র বিস্তৃতি ছড়ায় দুরন্ত গতিতে, নেতৃত্বে মির্জা কাদের । খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বইপড়া, নাটকে এমনকী চাঁদা তোলায় অপ্রতিরোধ্য এ বালকটি পড়াশোনায়ও ছিল মেধাবী । স্কুলজীবনে প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম তিনজনের মধ্যেই তাঁর অবস্থান থাকত । স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে । ‘৭৩ সালে মির্জা কাদের উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্র।

অসাম্প্রদায়িক, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, ছাত্র অধিকার আদায়ের অপ্রতিরোধ্য সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নীল পতাকার মাঝেই কাদের খুঁজে পেয়েছিল তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনদর্শন । ১ জানুয়ারির আগ পর্যন্ত প্রতিটি মুহুর্ত সংগঠন বিস্তারে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য । ভিয়েতনামে মার্কিনিদের অন্যায় আগ্রাসন প্রতিরোধে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কাদের সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতায় কলেজের ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করেছেন বহুবার। ‘৭৩ এর ১ জানুয়ারি কাদের সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার লড়াইয়ে ইতিহাসে পরিণত হন। ২০০০ সালে সার্বভৌম ভিয়েতনাম রাষ্ট্র এ আত্মদানের ঘটনায় মির্জা কাদেরুল ইসলামকে ‘ভিয়েতনামের জাতীয় বীর’ হিসেবে ঘোষণা দেয় ।

কাদেরের কন্ঠ এখনো সোচ্চার। যেখানে সাম্রাজ্যবাদের হিংস্র নখর পেখম মেলছে, কাদেরের প্রতিবাদী কণ্ঠ শোষিতের সাথে একাত্ম হচ্ছে। মতিউল-কাদেরের সংগ্রাম সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছেদ পর্যন্ত, মানবমুক্তির লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে । লাল সালাম মির্জা কাদেরুল ইসলাম। তোমার রক্তপতাকা হাতে আমরা চলি অবিরাম।